ডেইলি গোয়াইনঘাট ডেস্ক:: ২০২০ সাল বিশ্বব্যাপী একটি সংগ্রামমুখর অথচ অসুস্থ পরিবেশের সৃষ্টি করেছিল। করোনা ভাইরাসের বৈরী হাওয়ার মধ্যেও মানুষের মধ্যে দারিদ্র্য, খাদ্য, আশ্রয়, শিক্ষা ও প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা খাতে যে সমস্যাগুলো সৃষ্টি করেছে বিশ্বব্যাপী তার ঢেউ বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও লেগেছে। আশা করা যাচ্ছে, ২০২০-এর ক্ষতিকারক প্রভাব কাটিয়ে বাংলাদেশে ২০২১ সালে আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে তৃণমূল পর্যায়ে থেকে আরম্ভ করে উচ্চ পর্যায় পর্যন্ত প্রতিটি স্তরে মানবিকতা, নৈতিকতা ও সততার মাধ্যমে কণ্টকাকীর্ণ যাত্রাপথ অতিক্রম করে নতুন ভোরের আলোয় উন্নয়নের গতিময়তা দেখা দেবে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি যেমন মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণে সক্ষম তেমনি বণ্টনব্যবস্থা সুষম কি না, এবং কর্মপ্রত্যাশীদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা যথাযথভাবে করা হচ্ছে কি না সেদিকে লক্ষ্য করা জরুরি। যদি সামাজিক ন্যায়বিচার সমাজকাঠামোতে প্রতিষ্ঠিত হয়, তাহলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ২০২১ সালে দেশের সাধারণ জনমানুষের জীবনযাত্রার গতিময়তাকে অমলিনভাবে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে সহায়তা করবে।
যারা অন্যায়ভাবে পরসম্পদ লুণ্ঠন করে এবং শোষকের ভূমিকা পালন করছে, দেশ থেকে অর্থ পাচার করছে তাদের কেউ কেউ বিচারেরও সম্মুখীন হচ্ছেন। এটি অবশ্যই ইতিবাচক দিক। নতুন বছরে অন্যায়কারীরা যে দলেরই হোক, যে পেশারই হোক বিচারের সম্মুখীন আরো অধিকমাত্রায় হবেন। ’৭৫-পরবর্তী সময়ে যে বিচারহীনতার সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল, তা দেশের সর্বস্তরে ছড়িয়ে পড়ায় দুর্নীতি ও ঋণখেলাপি সংস্কৃতিকে পরিপুষ্ট করেছে। দুর্নীতি হ্রাস করা গেলে ন্যূনতপক্ষে ২.৭৫ শতাংশ জিডিপির প্রবৃদ্ধিতে প্রতি বছর যুক্ত হতো বলে আমি এক প্রাক্কলন করেছি। বঙ্গবন্ধু যে চারটি মৌলিক নীতিমালা অনুসরণ করে তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা সমুজ্জ্বল করেছিলেন সেগুলো হচ্ছে জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সমাজতন্ত্র। তার এই মৌলিক উদ্দেশ্যসমূহের মূল উদ্দেশ্য ছিল মানবহিতৈষী এবং জনকল্যাণ। বর্তমান সরকার প্রধান শেখ হাসিনা বিদায়ি বছরে জীবন ও জীবিকার মধ্যে সামঞ্জস্য বজায় রেখে দেশের অর্থনীতিকে গতিময়তা ও উন্নত সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে নিতে প্রয়াসী ছিলেন। করোনার সময়ে বিপুল জনসংখ্যার আধিক্য থাকা সত্ত্বেও তিনি ৩১টি ধাপে দেশের উন্নয়নে ও মানবকল্যাণে কাজ করেছেন। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখা গেছে, মধ্যম ও নিম্ন পর্যায়ের বাস্তবায়নকারীরা তার যে বিপুল উন্নয়নমালার পরিকল্পনা তা বাস্তবায়ন করেননি। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব হচ্ছে সিএসএমই খাতে ২০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ রেখেছিলেন। এখন এই ২০ হাজার কোটি টাকার মধ্যে কোনোমতে ব্যাংকগুলোর মধ্য দিয়ে ১০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনার প্যাকেজ বিতরণ করা গেছে। বাদবাকি অর্থ চলতি বছরের প্রথম তিন মাসের মধ্যে পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ এনজিও ফাউন্ডেশনের পার্টনার অরগানাইজেশনের মাধ্যমে বিতরণব্যবস্থা করা গেলে গ্রামীণ অঞ্চলের ক্ষুদ্র খামারিরা উপকৃত হবেন।
করোনাকালে স্বাস্থ্যবিধি বজায় রেখে ধীরে ধীরে স্কুল-কলেজ ১৭ জানুয়ারি থেকে খুলে দেওয়া যেতে পারে। এ লক্ষ্যে অবশ্যই পাইলট প্রকল্পের আওতায় স্বল্পসংখ্যক ছাত্রছাত্রী রয়েছে—এমন কিছু প্রাথমিক পর্যায়ে নির্বাচিত করা উচিত। স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকলেও গত বছর অনলাইনে ক্লাস হয়েছে, এ বছরও অব্যাহত থাকবে। ইন্টারনেট ও মোবাইল ফোনসেট ক্রয়ের জন্য সরকার ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করার পরও ইন্টারনেটের সমস্যায় গ্রামীণ ও শহরাঞ্চলের মধ্যে একধরনের বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে। এ বৈষম্য দূর করার লক্ষ্যে চলতি সালে অবশ্যই একটি শিক্ষাবিদদের সমন্বয়ে কমিটি গঠন করা যেতে পারে। ইতিমধ্যে সংগত কারণে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা কয়েক মাস পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। তবে পরীক্ষাবিহীন রেজাল্ট দেওয়া কোনোমতেই যুক্তিযুক্ত নয়। এক্ষেত্রে প্রয়োজনে অনলাইনে ওপেন বুক এক্সাম বা ডিসটেন্ট প্রক্টোরিয়াল সিস্টেমের আওতায় পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন ধাপে, বিভিন্ন সেটে পরীক্ষার ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
চলতি বছরও দেশের ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানিগুলো দেশ-বিদেশে ওষুধ বিক্রি বাড়াতে সক্ষম হচ্ছে। তবে খেয়াল রাখতে হবে—যে ফার্মাসিউটিক্যালগুলো বিদেশে নানা ওষুধ প্রেরণ করছে তারা মানসম্পন্ন ওষুধ দিচ্ছে কি না, যথাযথ কর দিচ্ছে কি না এবং রপ্তানিলব্ধ আয় চলতি বছরে সঠিক মাত্রায় দেশে নিয়ে আসছে কি না ।
এদেশে ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনায় আমূল পরিবর্তন আনা অত্যাবশ্যক হয়ে গেছে। গ্রাহকেরা আমানত বা ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করলে প্রতাপশালী না হলে অভিযোগ করেও সুফল পায় না। ডিসেম্বর পর্যন্ত ঋণখেলাপিদের বা ঋণগ্রহণকারীদের ঋণ শ্রেণিবিন্যাস না করতে দেওয়ার সিদ্ধান্ত বুমেরাং হয়েছে। আশা করা যায়, চলতি বছরে এ ব্যাপারে নতুন করে কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। ব্যক্তিস্বার্থ দেখার চেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত দেশের স্বার্থ দেখা। দেশে ঋণ বৈষম্যের কারণে মানুষের মধ্যে স্বাভাবিক শ্রদ্ধাবোধ ও সুসম্পর্ক হারিয়ে গেছে। দেশে অফিশিয়ালি দেখানো হচ্ছে বনসম্পদ ১১ শতাংশের মতো আছে। অথচ বাস্তবে বনসম্পদ উজাড় করার খেলায় অনেকেই মত্ত।
নতুন বছরে দেশে টিকা আমদানি করা হচ্ছে। এটি একটি সুসংবাদ। তবে টিকা আমদানির পাশাপাশি প্রযুক্তিগত হস্তান্তরের মাধ্যমে দেশি কোম্পানিগুলো ডব্লিউটিওর ট্রিপসের ব্যবহার মহামারির সময়ে বন্ধ রেখে টিকা প্রস্তুত করতে পারে। টিকার সুষ্ঠু সংরক্ষণ এবং বেসরকারিভাবে টিকা ক্রয় যাতে করা যায়, তার হিসাব রাখতে হবে। ১৬.৮ কোটি লোকের দেশে দুটো করে ডোজ দিলে প্রায় ৩৪ কোটি টিকার দরকার। এ বিশাল চাহিদার মধ্যে ৩ কোটি টিকা অত্যন্ত কম এবং সরকারকে অবশ্যই এসডিজির আওতায় বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প থেকে অর্থ কাটছাঁট করে খরচ করতে হবে। এজন্যই চলতি বছরে তৃণমূল পর্যন্ত টিকা প্রদান ও তত্সংশ্লিষ্ট সংরক্ষণ, উত্পাদন-বিপণন ও বাজারজাতকরণে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে জরুরি ভিত্তিতে সততার সঙ্গে ব্যবস্থা নিতে হবে। এ নিয়ে কোনো ধরনের হেলাফেলা ভালো নয়। ব্রিটেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও অ্যাস্ট্রাজেনকোর উদ্ভাবিত টিকা ব্রিটেনে ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে। রাশিয়াসহ যারা টিকা উদ্ভাবন করেছেন তাদের উদ্ভাবিত টিকা যাতে চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলো তৈরি করতে পারে তার দূতিয়ালির কাজ রাষ্ট্রদূত পর্যায়ে এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় প্রটোকোল মেইনটেইন করে করবে বলে আশা করা যায়। এমনিতেই আমাদের অনেক বুদ্ধিজীবী শিল্প উদ্যোক্তা প্রকৌশলী আর্মির কর্মকর্তা পুলিশ কর্মকর্তা, শিক্ষক, চিকিত্সক, নার্স, প্রকৌশলীসহ অনেককে হারিয়েছি। নতুন করে কাউকে হারাতে চাই না।
করোনার কারণে দেশের এসডিজি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া কিছুটা হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তার পরও আশা করব, সরকার তত্পরতার সঙ্গে আর্থিক সহায়তা, বিভিন্ন উন্নয়নমুখী ব্যাংক ও দাতাগোষ্ঠীর কাছ থেকে গ্রহণ করবেন এবং অর্থ যারা খরচ করবেন তারা যেন সতর্কতার সঙ্গে সে অর্থ খরচে মনোনিবেশ করে থাকেন।
অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় গড়ে প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশ নির্ধারণের পাশাপাশি মাথাগুনতি দারিদ্র্যের হার ২০২৫ সালের মধ্যে ১৫.৬ শতাংশ এবং চরম দারিদ্র্য হার ২০২০-২১ অর্থবছরে ১২ শতাংশ থেকে ২০২৪-২৫ সালের মধ্যে ৭.৪ শতাংশ হবে বলে প্রাক্কলন করা হয়েছে। তবে করোনাকালে কী পরিমাণ নতুন দারিদ্র্য এদেশে বিদেশের মতো হবে তার হিসাব করা উচিত। ২০২০-২১ অর্থবছরে সার্বিক সিপিআই মুদ্রাস্ফীতি ৫.৬৫ শতাংশ থেকে হ্রাস করে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৪.৭৬ শতাংশ হ্রাস করার কথা প্রাক্কলন করা হয়েছে। দেশে ২০১৯ সালে ট্যাক্স জিডিপি অনুপাত ছিল ৯.৬৩। এটি কোনোমতেই ২০-এর কম হওয়া উচিত নয়। নতুন প্রকল্পগুলোর মধ্যে কুমিল্লা-গোমতী-মেঘনা-কাঁচপুর রেলসড়ক নির্মাণ গ্রহণ করা বাঞ্ছনীয়। কুমিল্লায় একটি এয়ারপোর্ট নির্মাণ করাও দরকার। চলতি বছরে যাতে ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডাররা ইচ্ছামতো ক্রেতাসাধারণকে জিম্মি করে টাকা আদায় না করে সেদিকে খেয়াল রাখা দরকার। । অনলাইন ব্যবসায়ীরা ক্রেতাসাধারণকে বিভিন্ন ধরনের প্রলোভনে জুয়া খেলতে প্রলুব্ধ করছে। ভোক্তা অধিকার দপ্তরে কমপ্লেইন করেও লাভ হচ্ছে না।
সরকার ৪১তম, ৪২তম, ৪৩তম বিসিএসের আয়োজন করে প্রশংসনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। আমাদের দেশের বিসিএস পরীক্ষা মান্ধাতার আমলের। অন্তত ভারতের আইসিএস পরীক্ষায় ইংরেজি মাধ্যমের স্টুডেন্টদের যে সুযোগ দেওয়া হয় আমাদের পিএসসি সেটি অনুসরণ করতে পারে। গ্রামীণ ব্যাংকে কিছুদিন আগে লোক নেওয়ার জন্য আবেদনপত্র খুলল-কিন্তু ‘ও’ লেভেল এবং ‘এ’ লেভেলের পাশ করাদের জন্য ব্যবস্থা ছিল না। গ্রামীণ ব্যাংকের পুরোনো মডেল চলতি বছর সংশোধিত করতে সরকারের উদ্যোগী হওয়া উচিত। দেশে ক্ষুদ্র সঞ্চয়কে ক্ষুদ্র বিনিয়োগে আনার জন্য সামাজিক ব্যাংকিংয়ের প্রস্তাবনা অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় থাকা দরকার।
দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ ৪৩ বিলিয়ন ডলারে ছাড়িয়েছে। এটি সরকারকে অভ্যন্তরীণ ঋণ কার্যক্রম এবং স্থানীয় অর্থনীতিকে জোরদার করা ও কর্মপ্রত্যাশী যুবক-যুবতিদের জন্য কর্মসংস্থানে সহায়তা করতে পারে। সরকার ব্রিকসে ব্যাংকে যোগদানে ইচ্ছুক হয়েছে। এটির সদস্য হলে আমাদের অর্থনীতি চাঙ্গা হবে। গত বছর পদ্মা সেতুর স্প্যান বসানোর কাজ শেষ হয়েছে। চলতি বছরে যদি পদ্মা সেতুতে সড়কপথ অন্তত যেন সামনের বিজয় দিবসে খোলা যায় তবে দেশের মঙ্গল হবে; দারিদ্র্য দূরীকরণ হবে এবং জাতীয় প্রবৃদ্ধিতে সংযুক্তি ঘটবে। চলতি বছরে ছাত্র বলাত্কার ও নারী এবং শিশু নির্যাতন যাতে বন্ধ হয়, সে প্রত্যাশা থাকবে। উদ্যোক্তা তৈরির ক্ষেত্রে যেহেতু ঢাকা স্কুল অব ইকোনমিকস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে, ইকোনমিক ইনকিউবেটর এবং স্টার্ট আপের কাজ শুরুর জন্য বেসরকারি খাতে অর্থায়নের ব্যবস্থা করতে হবে। ব্লু ইকোনমি এর সুফল বাস্তবায়নের জন্য উদ্যোগ চলতি বছর থেকেই গ্রহণ করা উচিত।